সেই মিষ্টি হাসির পেছনের কান্না
আপনার কোলজুড়ে যে ছোট্ট শিশুটি এসেছে, তার প্রতিটি নতুন পরিবর্তনই বাবা-মায়ের জন্য এক বিশাল আনন্দের মুহূর্ত। বাচ্চার প্রথম হাসি, প্রথম উপুড় হওয়া, আর হামাগুড়ি দেয়ার মতোই আরেকটি বড় মাইলফলক হলো—প্রথম দাঁত ওঠা। সেই ফোকলা মাড়িতে যখন ছোট্ট সাদা মুক্তার মতো দাঁত উঁকি দেয়, সেই দৃশ্য পৃথিবীর যেকোনো বাবা-মায়ের জন্যই পরম আনন্দের।
কিন্তু এই আনন্দের পেছনের সময়টুকু সবসময় সুখকর হয় না। দাঁত ওঠার সময়টুকু বাচ্চার জন্য বেশ কষ্টদায়ক। মাড়ি ফুলে যাওয়া, লাল হয়ে থাকা, চুলকানি এবং তীব্র ব্যথা—সব মিলিয়ে বাচ্চা সারাদিন খিটখিটে হয়ে থাকে। খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয়, রাতে ঘুমাতে চায় না, আর সারাক্ষণ ঘ্যানঘ্যান কান্না তো আছেই। বাচ্চার এই কষ্ট দেখে বাবা-মায়ের মন খারাপ হওয়াই স্বাভাবিক।
অনেকেই এই সময় দ্রুত ব্যথা কমাতে ফার্মেসী থেকে জেল বা ঔষধ কিনে বাচ্চার মাড়িতে লাগিয়ে দেন। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এখন অনেক টিথিং জেল বা ঔষধ শিশুদের জন্য ক্ষতিকর বলে মনে করেন। তাহলে উপায়? উপায় আপনার হাতের কাছেই, আপনার রান্নাঘরে! দাদী-নানীদের আমল থেকে চলে আসা কিছু নিরাপদ ও কার্যকরী ঘরোয়া টোটকা বাচ্চার এই কষ্ট কমাতে ম্যাজিকের মতো কাজ করে। আজ আমরা জানব ঔষধ ছাড়াই রান্নাঘরের ৭টি উপাদান দিয়ে কীভাবে বাচ্চার দাঁত ওঠার যন্ত্রণা উপশম করবেন।
দাঁত ওঠার লক্ষণ: আপনি কীভাবে বুঝবেন?
সমাধানে যাওয়ার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার যে বাচ্চার কান্নাকাটির কারণ আসলেই দাঁত ওঠা কি না। সাধারণত ৬ মাস বয়স থেকে দাঁত ওঠা শুরু হয়, তবে অনেকের ৪ মাসে আবার অনেকের ১ বছর বয়সেও উঠতে পারে। লক্ষণগুলো হলো:
১. প্রচুর লালা বা থুথু পড়া (Drooling)।
২. হাতের কাছে যা পায় তাই কামড়াতে চাওয়া।
৩. মাড়ি ফুলে লাল হয়ে যাওয়া।
৪. খাবারে অরুচি।
৫. কান টানা বা গাল ঘষা।
৬. সামান্য গা গরম থাকা (তবে খুব বেশি জ্বর দাঁত ওঠার লক্ষণ নয়)।
রান্নাঘরের ৭টি জাদুকরী সমাধান (No Medicines Needed)
দাঁত ওঠার ব্যথা মূলত মাড়ির ভেতরের টিস্যু ফেটে দাঁত বের হওয়ার চাপের কারণে হয়। এই সময় মাড়িতে ঠান্ডা কিছু লাগলে বা শক্ত কিছু চিবোতে পারলে বাচ্চারা আরাম পায়। চলুন দেখে নিই রান্নাঘরের কী কী উপাদান আপনার বন্ধু হতে পারে।
১. ঠান্ডা শসা বা গাজরের টুকরো (Chilled Cucumber or Carrot)
রান্নাঘরের সবচেয়ে সহজলভ্য সবজি হলো শসা বা গাজর। এটি প্রাকৃতিক টিথার হিসেবে চমৎকার কাজ করে।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: একটি শসা বা গাজর ভালো করে ধুয়ে লম্বা ফালি করে কাটুন (বাচ্চার হাতের মুঠোয় যেন আটে)। এরপর এটি ফ্রিজে (নরমাল চেম্বারে) রেখে ঠান্ডা করুন। বরফ করবেন না, জাস্ট চিলড বা ঠান্ডা হতে হবে। ঠান্ডা শসার ফালিটি বাচ্চার হাতে দিন।
কেন কাজ করে: ঠান্ডা ভাব মাড়ির ফোলা ও ব্যথা অবশ (numb) করে দেয় এবং সবজির কচকচে ভাব মাড়ির শিরশিরানি কমায়।
সতর্কতা: বাচ্চা যেন বড় টুকরো গিলে না ফেলে সেদিকে কড়া নজর রাখুন। সবজিটি হাতে ধরে চিবোতে দিন, গিলে খেতে দেবেন না। সবচেয়ে ভালো হয় যদি "মেশ ফিডার" (Mesh Feeder) ব্যবহার করেন।
২. ফ্রিজে রাখা ভেজা সুতি কাপড় (Frozen Washcloth)
এটি অদ্ভুত শোনালেও বাচ্চার দাঁত ওঠার ব্যথায় এটি এক নম্বর ও সবচেয়ে নিরাপদ টোটকা।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: একটি পরিষ্কার, নরম সুতি কাপড় বা ছোট রুমাল নিন। এটি বিশুদ্ধ পানিতে ভিজিয়ে চিপে নিন। চাইলে পানির বদলে মায়ের বুকের দুধ বা ফর্মুলা দুধেও ভেজাতে পারেন। এরপর কাপড়টি একটি পরিষ্কার বক্সে ভরে ডিপ ফ্রিজে ৩০ মিনিট রাখুন। কাপড়টি যখন শক্ত ও ঠান্ডা হবে, তখন এটি বাচ্চার হাতে দিন চিবোনোর জন্য।
কেন কাজ করে: কাপড়ের খসখসে টেক্সচার মাড়ির চুলকানি কমায় এবং ঠান্ডা ভাব প্রদাহনাশক হিসেবে কাজ করে।
৩. ঠান্ডা স্টিলের চামচ (Cold Steel Spoon)
রান্নাঘরে চামচ নেই এমন বাড়ি খুঁজে পাওয়া যাবে না। প্লাস্টিকের টিথারের চেয়ে স্টিলের চামচ অনেক সময় বেশি কার্যকরী।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: একটি ছোট চা-চামচ বা ডেজার্ট স্পুন ফ্রিজের ভেতরে রেখে দিন। চামচটি যখন বেশ ঠান্ডা হবে, তখন এটি বাচ্চার মুখে দিন। চামচের উল্টো পিঠ (গোলাকার অংশ) দিয়ে আলতো করে বাচ্চার মাড়িতে ম্যাসাজ করুন বা তাকে চাটতে দিন।
কেন কাজ করে: মেটাল বা ধাতু ঠান্ডা বেশিক্ষণ ধরে রাখে। ঠান্ডা মেটালের স্পর্শ মাড়ির ব্যথা নিমিষেই কমিয়ে দেয়।
৪. জমানো কলা (Frozen Banana)
কলা শুধু পুষ্টিকর খাবারই নয়, এটি দাঁত ওঠার ব্যথার উপশমকারীও।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: একটি পাকা কলা খোসা ছাড়িয়ে মাঝখান থেকে কেটে আইসক্রিমের কাঠিতে গেঁথে ডিপ ফ্রিজে রেখে দিন। অনেকটা "ব্যানানা পপসিকল" এর মতো হবে। জমে গেলে এটি বাচ্চাকে চুষতে দিন। তবে ৬ মাসের কম বয়সী বাচ্চাদের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়।
কেন কাজ করে: কলার মিষ্টি স্বাদ বাচ্চাকে শান্ত করে এবং ঠান্ডা ভাব ব্যথা কমায়। তবে কলার টুকরো যেন গলায় আটকে না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
৫. মায়ের বুকের দুধের পপসিকল (Breastmilk Popsicle)
যদি বাচ্চার বয়স ৬ মাসের কম হয় এবং সে সলিড খাবার না খায়, তবে এটিই সেরা উপায়।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: আইসক্রিমের বা পপসিকলের মোল্ডে (Mould) মায়ের বুকের দুধ বা ফর্মুলা মিল্ক ঢেলে ডিপ ফ্রিজে জমিয়ে নিন। এরপর সেই দুধের আইসক্রিমটি বাচ্চাকে খেতে দিন। এটি বাচ্চার পুষ্টির চাহিদাও মেটাবে আবার ব্যথও কমাবে।
কেন কাজ করে: ঠান্ডা বরফ মাড়ির অনুভূতি ভোঁতা করে দেয়, ফলে বাচ্চা ব্যথা টের পায় না।
৬. নিজের পরিষ্কার আঙুলের ম্যাসাজ (Finger Massage)
সবসময় হাতের কাছে কিছু না-ও থাকতে পারে। তখন মা বা বাবার হাতের আঙুলই বাচ্চার জন্য বড় ওষুধ।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: আপনার হাত খুব ভালো করে সাবান দিয়ে ধুয়ে জীবাণুমুক্ত করুন। এরপর তর্জনী (Index finger) দিয়ে বাচ্চার মাড়িতে হালকা চাপ দিয়ে ডলে দিন বা ম্যাসাজ করুন।
কেন কাজ করে: মাড়িতে পাল্টা চাপ (Counter pressure) প্রয়োগ করলে বাচ্চার বেশ আরাম লাগে। বাচ্চারা স্বভাবতই কামড়াতে চায়, তাই আপনার শক্ত আঙুল পেলে তারা কামড়ে আরাম পাবে।
৭. পেয়ারা বা আপেলের স্লাইস (Guava or Apple Slice)
বাচ্চা যদি চিবুতে শিখে থাকে, তবে শক্ত ফল বেশ উপকারী।
কীভাবে ব্যবহার করবেন: আপেল বা পেয়ারা ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করে নিন। এরপর এমন আকারে কাটুন যা বাচ্চা সহজে ধরতে পারবে কিন্তু একবারে গিলে ফেলতে পারবে না।
সতর্কতা: এই পদ্ধতিতে দম আটকে যাওয়ার (Choking) ঝুঁকি থাকে। তাই বাচ্চা যখন এটি চিবোবে, আপনাকে অবশ্যই চোখের পলক না ফেলে সামনে বসে থাকতে হবে। নিরাপদ থাকতে "ফ্রুট ফিডার" বা চুষনি ব্যবহার করাই বুদ্ধিমানের কাজ।
দাঁত ওঠার সময় কী করবেন না?
১. অ্যাসপিরিন বা ব্যথানাশক ঔষধ: ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া কখনোই বাচ্চাকে ব্যথানাশক ঔষধ খাওয়াবেন না।
২. অ্যালকোহল: মাড়িতে অ্যালকোহল ঘষবেন না।
৩. অ্যাম্বার নেকলেস: অনেকে গলায় পুঁতির মালা পরান, এটি গলায় পেঁচিয়ে শ্বাসরোধের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে। এটি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়।
৪. মধু: ১ বছরের নিচের বাচ্চাকে মধু দেবেন না, এতে 'বটুলিজম' নামক মারাত্মক রোগের ঝুঁকি থাকে।
বাবা-মায়ের করণীয় এবং ধৈর্য
বাচ্চার দাঁত ওঠার সময়টা বাবা-মায়ের জন্য ধৈর্যের পরীক্ষা। বাচ্চা খাবে না, ঘুমাবে না, কাঁদবে—এটা মেনে নিতে হবে। এই সময় তাকে বাড়তি আদর ও সময় দেওয়া প্রয়োজন। বাচ্চাকে বুকের দুধ খাওয়ানোর সময় সে কামড়ে দিতে পারে, এতে রাগ করা যাবে না। মনে রাখবেন, এই কষ্টটা সাময়িক। কয়েক দিন পরই যখন ঝকঝকে সাদা দাঁতটি বেরিয়ে আসবে, তখন এই সব কষ্ট ভুলে যাবেন।
বাচ্চার মাড়িতে যদি অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ হয়, বা ১০১ ডিগ্রির উপরে জ্বর থাকে, অথবা বাচ্চা অনবরত ডায়রিয়া করতে থাকে—তবে এটি কেবল দাঁত ওঠার লক্ষণ না-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে দেরি না করে শিশু বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিন।
উপসংহার
প্রকৃতি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান হাতের কাছেই দিয়ে রেখেছে। বাচ্চার দাঁত ওঠার এই নাজুক সময়ে রাসায়নিক জেলের চেয়ে রান্নাঘরের এই ঠান্ডা ও প্রাকৃতিক উপাদানগুলো অনেক বেশি নিরাপদ। শসা, গাজর, বা নিছক একটা ঠান্ডা চামচ—এগুলোই হতে পারে আপনার সোনামণির স্বস্তির কারণ।
তবে হ্যাঁ, ঘরোয়া টোটকার পাশাপাশি কিছু নিরাপদ ও মানসম্মত টিথিং টয় (Teething Toys) বা ফুড ফিডার ব্যবহার করলে জীবনটা আরও সহজ হয়ে যায়। বাচ্চারা যেহেতু সবকিছু মুখে দেয়, তাই সেই জিনিসটি হতে হবে ১০০% ফুড গ্রেড এবং বিপিএ (BPA) মুক্ত।
আর এখানেই আপনার পাশে আছে TrustShopBD।
কেনাকাটার সেরা ঠিকানা: TrustShopBD
আপনার সোনামণির এই কঠিন সময়ে তাকে একটু আরাম দিতে চান? TrustShopBD ( নিয়ে এসেছে বাচ্চাদের জন্য প্রিমিয়াম কোয়ালিটির টিথিং সলিউশন।